শুক্রবার, ২৭ Jun ২০২৫, ০৬:২০ অপরাহ্ন
নাহিদ হাসান:
মানুষের জীবনে চরিত্রই সবচেয়ে বড় সম্পদ। পদ-পদবি, অর্থবিত্ত কিংবা শারীরিক সৌন্দর্য সবকিছুকেই মøান করে দিতে পারে চরিত্রহীনতা। পক্ষান্তরে সদাচরণ, সততা, বিনয়, সহানুভূতি ও আমানতদারিতায় গঠিত চরিত্র মানুষের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয় আকাশসম উচ্চতায়। মানবিক সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই সমাজ ও সংস্কৃতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে উত্তম চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। একজন মানুষ কতটা জ্ঞানী, ধনী বা প্রভাবশালী, তা সমাজের জন্য বড় বিষয় নয়; বরং সে কতটা নীতিবান, সত্যবাদী, দায়িত্বশীল এবং দয়ার্দ্র হৃদয়ের অধিকারী, এই গুণগুলোই মানুষের হৃদয় জয় করে এবং মানুষের অন্তরকে করে প্রশান্তিময়।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা কেবল ইবাদতের নির্দেশই দেয়নি; বরং ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নৈতিকতার ভিত্তিতে উন্নত চরিত্র গঠনের দিকনির্দেশনাও দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রেরণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মানুষের চরিত্র সংশোধন। তিনি উত্তম চরিত্র পরিপূর্ণ করার জন্যই প্রেরিত হয়েছিলেন। (মুসনাদে আহমদ) এই হাদিসের ভাষ্য প্রমাণ করে, ইসলাম কেবল নামাজ, রোজা ও হজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং মানুষের চারিত্রিক উৎকর্ষ অর্জনকেও দ্বীনদারির মৌলিক অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে। তাই একজন মুসলমানের জন্য শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং মানবিক গুণাবলির বিকাশও অত্যাবশ্যক। উত্তম চরিত্র কেবল আখেরাতের সফলতার জন্য নয়; দুনিয়াতেও তা মানুষের শান্তি ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয়। একজন নীতিবান মানুষ পরিবারে যেমন শ্রদ্ধাভাজন হন, তেমনি সমাজে হয়ে ওঠেন অনন্য এক আদর্শ। তিনি অন্ধকারে আলো জ্বালান, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, মানুষের পাশে দাঁড়ান এবং অপরকে সম্মান দিয়ে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে উত্তম চরিত্র গঠনের উপায় নিয়ে আলোচনা করা সময়ের চাহিদা। কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত নানা নির্দেশনা থেকে জানা যায়, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, বিনয়, ধৈর্য, করুণা, ইনসাফ ও আত্মসংযম, এসব গুণ অর্জনের মাধ্যমেই গড়ে তোলা যায় একজন পরিপূর্ণ মুমিনের আদর্শ চরিত্র। এখানে এসব বিষয় নিয়ে বিবরণী তুলে ধরা হলো।
সত্যবাদিতা : আল্লাহতায়ালা ও তার রাসুল (সা.) আমাদের যেসব চরিত্রের নির্দেশ দিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে সত্যবাদিতা। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’ (সুরা তাওবা ১১৯)
আমানতদারিতা : উত্তম চরিত্রের একটি দিক হচ্ছে আমানতদারিতা। আল্লাহতায়ালা আমানতদারিতার বিষয়ে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, আমানতগুলো তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে।’ (সুরা নিসা ৫৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ গুণের জন্যই তার সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আল-আমিন উপাধি লাভ করেছিলেন।
বিনয় ও নম্রতা : উত্তম চরিত্রের আরেকটি দিক হচ্ছে বিনয় ও নম্রতা। একজন মুসলমান তার অন্য মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে বিনয়ী আচরণ করবে। সে ধনী হোক বা গরিব হোক। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তোমরা বিনয়ী হও। একজন অন্যজনের প্রতি অহংকার কোরো না এবং একজন অন্যজনের ওপর সীমালঙ্ঘন কোরো না। (সহিহ মুসলিম)
পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার : পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা উত্তম চরিত্রের অন্যতম। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহর ইবাদত করো, তার সঙ্গে কোনো কিছু শরিক কোরো না এবং মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো।’ (সুরা নিসা ৩৫)। এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা মাতা-পিতার প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য আয়াতে তিনি তাদের প্রতি দয়া ও বিনয়পূর্ণ আচরণ এবং তাদের জন্য দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা : আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ওয়াজিব। আর তা ছিন্ন করা জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং অভিশাপের কারণ। কোরআনে এ বিষয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তোমরা ক্ষমতা পাও, তাহলে কি তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তারা তো ওইসব লোক, যাদের প্রতি আল্লাহতায়ালা অভিশাপ করেছেন। তিনি তাদের বধির করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন।’ (সুরা মুহাম্মদ ২২-২৩)
অঙ্গীকার পূর্ণ করা : উন্নত চরিত্র গঠন করার ক্ষেত্রে এ দিকটি ভালোভাবে পালন করতে হবে। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো, কেননা অঙ্গীকার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা ইসরা ৩৪)। এ ছাড়া হাদিসে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করাকে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার : প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করা উত্তম চরিত্রের অন্যতম দিক। প্রতিবেশী বলা হয় সেসব লোককে যারা আমাদের বাড়ির আশপাশে বসবাস করে। প্রতিবেশীদের প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন, নিকটতম প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতিও।’ (সুরা নিসা ৩৬)
ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা : ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা হলো উত্তম চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যে ধৈর্যধারণ ও ক্ষমা করল, নিশ্চয়ই এটা কাজের দৃঢ়তার অন্তর্ভুক্ত’। (সুরা শুরা ৪৩)
লজ্জা : লজ্জা এমন একটি চরিত্র, যা পরিপূর্ণতা ও মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে আহ্বান করে। লজ্জা অন্তরে ইমান থাকার প্রমাণ বহন করে। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘লজ্জা কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না।’
(সহিহ মুসলিম)
ন্যায়পরায়ণতা : ন্যায়পরায়ণতা আত্মার প্রশান্তি সৃষ্টি করে। সমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন প্রকার অপরাধ বিমোচন করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ইনসাফ করো, এটা তাকওয়ার অতীব নিকটবর্তী।’ (সুরা মায়িদা ৮)
দয়া ও করুণা : এ চরিত্রটি অনেক মানুষের অন্তর থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে তাদের অন্তর পাথরের মতো কিংবা তার চেয়ে অধিক শক্ত হয়ে গেছে। আর প্রকৃত মুমিন হচ্ছে দয়াময়, পরোপকারী ও গভীর অনুভূতিসম্পন্ন উজ্জ্বল অনুগ্রহের অধিকারী। এ বিষয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুমিনদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, করুণা ও অনুকম্পার উপমা হচ্ছে একটি শরীরের মতো। যখন তার একটি অঙ্গ অসুস্থ হয় তখন গোটা শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’
চারিত্রিক পবিত্রতা : উত্তম চরিত্রের অন্যতম বিষয় হচ্ছে চারিত্রিক পবিত্রতা। আল্লাহতায়ালা এ বিষয়ে বলেন, ‘যাদের বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, তারা যেন চারিত্রিক পবিত্রতা গ্রহণ করে। যতক্ষণ না আল্লাহ তার অনুগ্রহে তাকে সম্পদশালী করেন।’ (সুরা নুর ৩৩) রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা আমার জন্য ছয়টি বিষয়ের জিম্মাদার হও। তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব। যখন তোমাদের কেউ কথা বলে, সে যেন মিথ্যা না বলে। যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, তখন সে যেন তার খেয়ানত না করে। যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তা যেন ভঙ্গ না করে। তোমরা তোমাদের দৃষ্টি অবনত করো। তোমাদের হস্তদ্বয় সংযত করো। তোমাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করো।’উত্তম চরিত্র গঠন কোনো তাৎক্ষণিক কর্ম নয়; বরং এটি একটি ধারাবাহিক সাধনা ও আত্মগঠনের ফল। ইসলামের আলোকে সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, বিনয়, ধৈর্য, দয়া, ইনসাফ ও আত্মসংযমের মতো গুণাবলি হৃদয়ে ধারণ করলেই একজন ব্যক্তি গড়ে তুলতে পারে একটি আদর্শ জীবনব্যবস্থা। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই ছিল উত্তম চরিত্রের অনুপম দৃষ্টান্ত। তাই আমাদের উচিত তাকে অনুসরণ করে জীবন গঠন করা। উত্তম চরিত্র শুধু ব্যক্তিগত উন্নতির পথ নয়, বরং তা পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করে, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে এবং জাতিকে এনে দেয় সম্মান ও অগ্রগতি। বর্তমান বৈষয়িক ও আত্মকেন্দ্রিক সমাজে চারিত্রিক অবক্ষয় রোধে এই গুণাবলির চর্চা অপরিহার্য। প্রত্যেক মুসলমান যদি আন্তরিকভাবে নৈতিক মূল্যবোধ অনুসরণ করে, তবে সে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতার অধিকারী হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে উত্তম চরিত্রে ভূষিত হয়ে তার প্রিয় বান্দা হওয়ার তাওফিক দিন। আমিন।
ভয়েস/আআ